স্মেল রেকর্ডার
১.
খুন…..
চারপাশে হট্টগোল। প্রফেসর শামসুজ্জোহা দুষ্কৃতকারীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। কখন খুন হয়েছেন তা কেউ কিছুই জানে না। সকাল বেলায় ধান খেতে ওনার লাশটি পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে মৃতদেহ তুলে নিয়ে গেছে।
শামসুজ্জোহা ছিলেন খুবই ভদ্র লোক। তার কোন শত্রু থাকতে পারে তা কারোই ধারণা ছিল না। পুলিশ সন্দেহভাজন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও কোন কূল কিনারা করতে পারছে না। প্রফেসর শামসুজ্জোহা বিজ্ঞানী হিসেবে সমাদৃত ছিলেন। গবেষণার পিছনে সময় দিতে গিয়ে বিয়ের কাজটিও সম্পন্ন করতে পারেননি। পুরো দেশজুড়ে ওনার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়েছে। টেলিভিশন, পত্রিকা, রেডিও সব জায়গাতেই ওনার চাঞ্চল্যকর মৃত্যুকে ঘিরে নানা ধরণের সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকলো। কিছুদিন যেতেই আস্তে আস্তে সবাই যেন ঝিমিয়ে পড়লো। অন্যান্য মৃত্যু সংবাদের মত ওনার মৃত্যু সংবাদটাও স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়াল। ওনার কথা এখন আর কেউ সেভাবে তুলে ধরছে না। সবাই যেন তাঁকে ভুলতে শুরু করলো।
ততদিনে প্রফেসর ইসমাইল হুসেন বিজ্ঞানী হিসেবে পুরো বিশ্বে সমাদৃত হয়ে গেছেন। ইসমাইল হুসেন এমন একটি যন্ত্র তৈরি করেছেন যার দ্বারা অডিও বা ভিডিও কলের মত স্মেল বা গন্ধকে রেকর্ড করে রাখতে পারে। এই যন্ত্র দ্বারা কারও প্রিয় গন্ধকে ধারণ করে যেকোন সময় অবিকল সেই গন্ধটিই ফিরে পাওয়া সম্ভব। যা সহজে ধ্বংস হবে না, যখন খুশি তখনই স্মেল রেকর্ডার চালু করলেই হলো। প্রফেসর ইসমাইল হুসেন বাণিজ্যিকভাবে যন্ত্র তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ শুরু করে দিলেন। স্মেল রেকর্ডার বিক্রয় করে তিনি অল্প সময়ের ব্যবধানে বিজ্ঞানী থেকে ধনকুবের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠলেন। তার কারখানায় এখন বেশ কয়েকশো লোক কাজ করে। মো: হামিদ ছিলেন কর্মীদের মধ্যে অন্যতম একজন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ, মেধাবী এবং ধুরন্ধর। তার আরেকটি পরিচয় হলো তিনি প্রফেসর শামসুজ্জোহার ছাত্র। তবে বিষয়টি ইসমাইল হুসেনের অজানা ছিল। হামিদ প্রফেসরের খুনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। প্রফেসর শামসুজ্জোহার খুনের পিছনে তার সন্দেহের তীর প্রফেসর ইসমাইলের দিকেই।
২.
হাশেম মিয়া প্রফেসর ইসমাইল হুসেনের একজন বিশ্বস্ত গৃহকর্মী। ইসমাইল হুসেনের বাড়ির সমস্ত খুঁটিনাটি ছিল তার নখদর্পণে, শুধু একটি মাত্র ছোট কক্ষ ছাড়া। যে কক্ষে প্রফেসর তার সারাদিন-রাত ব্যয় করেন। ইসমাইলের বাড়িতে আসা যাওয়ার সূত্র ধরে মো: হামিদের সাথে হাশেম মিয়ার ভালো সখ্যতা গড়ে ওঠে। হাশেম মিয়ার সব কিছুতেই জানার খুব আগ্রহ। বিষয়টি হামিদের নজরে পড়তে বেশিদিন সময় ব্যয় করতে হয়নি। তাই হামিদ চিন্তা করলেন হাশেম মিয়ার এই আগ্রহটাকেই কাজে লাগাবেন।
ইদানিং প্রফেসর ইসমাইল হামিদকে সবার চেয়ে বিশ্বস্ত ভাবা শুরু করেছেন যা ছিল হামিদের পরিকল্পনার একটি অংশ। বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রফেসরের বাসায় হামিদের আসা যাওয়া করতে হয়। আর হামিদ সেই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। বাসায় আসা যাওয়ার সূত্র ধরে হাশেম মিয়ার সাথে আন্তরিকতা বাড়াতেও দক্ষতার ছাপ রাখেন মোঃ হামিদ। এভাবে আরও বেশ কয়েক বছর সব স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকলো।
একদিন প্রফেসর ইসমাইল ভুল করে তার চশমা বাসায় ফেলে আসেন। তিনি চশমা আনার জন্য হামিদকে তার বাসায় পাঠান। হামিদ হাশেমকে চশমা খুঁজে আনতে বলে ড্রইং রুমে বসলেন। ড্রইং রুমে বসতেই তার চোখ-মুখে যেন আনন্দের ঢেউ বয়ে গেলো। ড্রইংরুমের সোফার কাছে প্রফেসরের চশমাটি পড়েছিল। চশমাটির ঠিক পাশেই একটি চাবি চকচক করতে লাগলো। হামিদ চশমাটি দ্রুত লুকিয়ে ফেললেন আর চাবিটা টি-টেবিলের ওপর রেখে দিলেন। চশমা খোঁজার ছুতোয় মোঃ হামিদ হাশেমকে নিয়ে প্রফেসরের সেই গোপনীয় কক্ষে প্রবেশ করলেন।
কক্ষে প্রবেশ করার পরপরই তারা অবাক হয়ে গেলেন। কক্ষ খোলার সাথে সাথেই সুগন্ধির গন্ধে তাদের প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। তবে মো: হামিদের কাছে ঘ্রাণটি খুবই পরিচিত মনে হলো। হামিদের মনে হচ্ছিল প্রফেসর শামসুজ্জোহা যেন তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন।
হাশেমের নজর এড়িয়ে হামিদ পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে একটি অব্যবহৃত বোতলের ছিপি পকেটে লুকিয়ে ফেললেন। তিনি মনে করেন এই ছিপিটিই প্রফেসর শামসুজ্জোহার আসল খুনিকে পাইয়ে দেবে। হয়তো তিনি যা ধারণা করছেন তা-ই সঠিক। আবার না-ও হতে পারে।
হাশেম চশমা খুঁজতে ব্যর্থ হয়ে যখন কক্ষ থেকে বের হতে যাচ্ছিল তখনই হামিদের চতুরতায় হাশেম চশমাটির সন্ধান পায়। তবে তা হামিদের পকেটে নয়, কক্ষের এক কোণে আধখোলা অবস্থায় চশমাটি পড়েছিল। চশমাটি হাতে পাওয়ার সাথে সাথেই হাশেম দ্রুত কক্ষটি লাগিয়ে ফেললেন।
৩.
হামিদ রাতে কাজ শেষে বাসায় এসে প্রফেসর ইসমাইলের বাসা থেকে পাওয়া বোতলের ছিপিটি একটি বাল্বের সামনে রেখে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখতে লাগলেন। তিনি খেয়াল করলেন ছিপিটির একপাশে সামান্য ক্ষয়প্রাপ্ত। প্রফেসর শামসুজ্জোহার কক্ষ থেেক উদ্ধারকৃত একটি বোতল হাতে নিয়ে পরখ করতেই হামিদ চমকে উঠলেন। বোতলের গায়ে দাগ পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায় ছিপিটা এই বোতলেরই। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন প্রফেসর শামসুজ্জোহার সাথে প্রফেসর ইসমাইলের কোন যোগসূত্র আছে।
পরদিন প্রফেসর ইসমাইল পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতেই কারও বুঝতে বাকি রইল না যে প্রফেসর শামসুজ্জোহার আসল খুনি কে। জানা যায় বেশ কিছুদিন আগে প্রফেসর শামসুজ্জোহা এক জায়গায় একটি ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। তিনি ব্যাগের মালিককে খুঁজে ব্যাগ বুঝিয়ে দিতে গেলেই বাঁধে বিপত্তি। ব্যাগটি আর কারও নয়, ব্যাগটি ছিল প্রফেসর ইসমাইলের। ইসমাইল চাননি তার আবিষ্কারের পেটেন্ট সম্পর্কে আগে থেকেই কেউ কিছু জেনে যাক। প্রফেসর ইসমাইলের সন্দেহ হতে থাকলো এই ব্যাগটি যিনি পেয়েছিলেন তিনি নিশ্চয়ই তার আবিষ্কার সম্পর্কে কিছু না কিছু জেনে গেছেন। না হলে উনি কী করে ইসমাইলের হদিস পাবেন। তার উপর যিনি পেয়েছিলেন তিনিও একজন বিজ্ঞানী। তাই প্রফেসর ইসমাইলের মাথায় খুনের ইচ্ছা চেপে বসল।
তবে দু’টি বিষয় হামিদের মাথায় খটকা লাগলো। ইসমাইল প্রফেসর শামসুজ্জোহাকে মারার উদ্দেশ্যে পিস্তল চালালেও তিনি তার বুকে দূর থেকে একটি মাত্রই গুলি করেছেন। গুলি ভেদ করার পর প্রফেসর শামসুজ্জোহাকে পড়ে যেতে দেখেই তিনি দ্রুত পালিয়ে যান। তাহলে শামসুজ্জোহার শরীরে যে আঘাতের চিহ্ন সেগুলো আসলো কীভাবে! স্মেল রেকর্ডার যে প্রফেসর ইসমাইল আবিষ্কার করেছেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাহলে যে বোতলটি খুনিকে পাইয়ে দিলো সেটিই বা ইসমাইলের বাসায় আসলো কীভাবে?
Pratilipi., লেখা জমা দেওয়ার ফর্ম