সত্তা
– রফিকুল নাজিম
০১.
-কি করছো, পিকুল? এখনো হয়নি তোমার? সেই কখন থেকে বলছি রেডি হও রেডি হও। আমার কথা তো
তোমার কানেই যায় না।
-সরি, নীরু। এই তো সোনা- হয়ে গেছে প্রায়।
– তোমার হয়ে গেলে বাবাইকে কোলে নাও। শুনতে পাচ্ছো না কেমন কাঁদছে ছেলেটা? আচ্ছা, দেখো তো ও
হিসু করেছে কিনা?
– না। ও ঠিক আছে। দ্রুত সারো তো। ডাঃ ইসরাতের সাথে দেখা করে আমরা বাবাইর জন্য কেনাকাটা করতে
মার্কেটে যাবো।
০২.
ঠিকই ধরেছেন- যার সাথে এতোক্ষণ কথা বলছিলাম সে নীরা- আমার স্ত্রী। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে
সাজুগুজু করছে। আর বাবাই? আমাদের একমাত্র সন্তান। ওর বয়স চার মাস। নীরা পছন্দ করে ছেলের নাম
রেখেছে পল্টু বাবাই। সারাদিন পল্টুকে নিয়েই সে থাকে। বেশ চটপটে ও প্রাণবন্ত মানুষ নীরু। ঘরে তার
উপস্থিতি মানেই বিষন্ন রাতে একগাল জোছনার মতো খলখলে ঢেউ তোলে! তার হাসি মানেই গহীন জলের
ছলাৎ সুর। খুব মিশুক ও কেয়ারিং নীরু। ও হ্যাঁ, আমাদের কিন্তু এরেঞ্জ ম্যারিজ। ছয় বছর হলো মায়ের পছন্দেই
নীরাকে বিয়ে করেছি।
পল্টুর বড় বোন- পরী। ও অবশ্য পৃথিবীর আলোই দেখেনি। সাত মাস বয়সে নীরুর পেটেই সে মারা যায়।
পরীর চলে যাওয়ার পর নীরু আর তেমন কারো সাথে কথা বলতো না। বিনা নোটিশে আমার সাথে খুব অভিমান
করতো। হুটহাট আবদার করে বসতো। একদিন হলো কি- ভরা পূর্ণিমা রাতে সে আবদার করে বসলো-
বটগাছের নিচে বসে জোছনা দেখবে। তার কথা মতো শহরতলী থেকে প্রায় দুই মাইল পথ পায়ে হেঁটে
খেয়াঘাটের বটতলায় বসে মধ্যরাত পর্যন্ত আমরা জোছনা দেখেছি। মাঝে মাঝে রাতে ঘুমের মধ্যে নীরু হঠাৎ
কেঁদে উঠতো। নীরুর জন্য খুব কষ্ট হতো আমার। ঐদিনগুলো নিজেকে খুব অসহায় লাগতো।
পল্টু বাবাই পেটে আসার পরই নীরু পুরোদস্তুর স্বাভাবিক হয়ে যায়। নীল শাড়ি পরে। বারান্দায় বসে প্রায়শই
রবীন্দ্র সংগীত গায়। পল্টুকে নিয়ে হাজারো স্বপ্নের নকশী কাঁথা বুনন করে। আমিও গদোগদো হয়ে তার সব
প্ল্যানে হুম হুম করি। গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাঃ হাসি আহমেদের তত্ত্বাবধানে আছে নীরু। ডাক্তারের পথ্য ও নির্দেশনা
খুব মনোযোগ দিয়ে পালন করে সে। বমির ভাব হলেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে রুটিন মাফিক পুষ্টিকর খাবার পানি দিয়ে
গিলে খায়। কার কাছে যেন শুনেছে- ভালো খাবার আর মায়ের হাসিখুশি থাকার উপর নির্ভর করে পেটের শিশুর
বিকাশ। তাই সে সবসময় হল্লা করে ঘরটাকে মাথায় তুলে রাখে। আমার কাছেও ঘরটা স্বর্গের মতোই ঠেকে।
সারাদেশ লকডাউন। করোনা নামক এক অদৃশ্য যমদূত পুরো বিশ্বকে শাসন করছে। প্রতিদিনই হাজারো
লাশের সারি পড়ছে। একদিন ভোরে নিরুর ডাকে আমার ঘুম ভাঙে। পেটটা দু’হাতে চেপে ধরে বললো- পেটে
ব্যথা খুব হচ্ছে। বুঝতে বাকি রইলো না যে, নীরুর প্রসব ব্যথা উঠেছে। নীরুর মা ও তার বড়বোন খবর পেয়েই
সাথে সাথে চলে এসেছে। সবকিছু স্বাভাবিক। নীরুও বেশ সুস্থ। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী আতুড়ঘরে প্রস্তুতি সম্পন্ন
করে রেখেছেন। এদিকে আমি পল্টুর কান্নার আওয়াজ শোনার জন্য আঁতুড়ঘরের দরজায় কান পেতে রইলাম।
ছোটভাই আতিক আযান দেয়ার জন্য অযু করে এসেছে। ডাক্তার নীরুর শরীরে স্যালাইন ও ইনজেকশন পুশ
করার কিছুক্ষণ পরই পল্টু পৃথিবীর আলোয় আসলো। কিন্তু কোনো কান্না করছে না। নীরুর মা দরজা খুলেই
কান্না শুরু করলো। পল্টু বাবাই শ্বাস নিতে পারছে না। আগে থেকেই এম্বুল্যান্স বলা ছিলো। এম্বুল্যান্সে করে
আমরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটছি। প্রাইভেট হাসপাতালের দরজায়ও লেখা “Closed”
আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও পল্টুকে সুস্থ করে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চাচ্ছিলাম। পরীর মৃত্যুর
পর নীরুর যে মুখটা দেখেছিলাম- সেই মুখটাই বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এবার পল্টুর কিছু
হলে নিরুকে বুঝি আর বাঁচানো যাবে না।
অবশেষে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে একজন ডাক্তারকে পেলাম। তিনি সবকিছু
দেখে সরি বলে চলে গেলেন। বিশ্বাস করুন- আমার চোখ থেকে একফোঁটা জলও গড়ায়নি। বাড়ি ফেরার
পুরোটা পথ আমি পল্টু বাবাইকে দেখছিলাম। মন ভরে দেখছিলাম। আসলে আমি পল্টুকে দেখছিলাম না,
দেখছিলাম নীরুকে। নীরুর পুরো সত্তা পল্টুর গালে খেলা করছিলো!
আমাদের বকুলতলায় পল্টুর কবর খোঁড়া হয়েছে। সাদা কাফনে মোড়ানো পল্টু বাবাই আমার কোলে ঘুমাচ্ছে।
নীরুর সামনে কান্না লুকাতে গিয়ে আমার মাথার পেছনটা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন। নিরুকে বাম হাতে আমার
বুকে চেপে ধরেছিলাম। ডান হাতে ধরে রেখেছি আমাদের পল্টুকে। পল্টু ঘুমাচ্ছে। পল্টুর লকলকে আঙুল
ধরে নীরু ডাকছে ,’বাবাই রে, এবার আমার কোলে আয়। এই দুষ্টু তোকে আর ঘুমাতে হবে না। জানিস- তোর
জন্য আমি অনেকগুলো বল কিনেছি, গাড়ি কিনেছি রে। আয় আমরা খেলবো। কত রাত না ঘুমিয়ে আমি
তোকে শুনাবো বলে অনেকগুলো কিচ্ছা শিখেছি। বেশ ক’টা রাইমস্ শিখেছি। বাবাকে এবার ছাড়। আমার
কোলে আয় রে সোনা।’
০৩.
তারপর নীরুর জ্ঞান ফিরে আসে দুদিন পর। গত চার মাস ধরে সে খুব মানসিকভাবে অসুস্থ আছে। মনোরোগ
বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইসরাত জাহানের পরামর্শে তাকে পল্টুর মতো একটা পুতুল কিনে দিয়েছি। নীরু সন্তান প্রসব
করলেও সে মা হতে পারেনি। বিশ্বাস করুন- নীরু নিঃসন্তান নয়। সে বন্ধ্যা নয়। এইযে আপনারা যেই পুতুলটা
দেখছেন, আসলে সেটা পুতুল নয়। ও আমাদের পুতুল পুতুল পল্টু বাবাই।